শুক্রবার , ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

টেকনাফ

খালেদা আজ সেনানিবাসে, হাসিনা দেশছাড়া

খালেদা আজ সেনানিবাসে, হাসিনা দেশছাড়া
ডাঃ ওয়াজেদ খান
বেগম খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে নির্দয়ভাবে উচ্ছেদ করেন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে উচ্ছেদ প্রক্রিয়াটি ছিলো অত্যন্ত অপমানজনক। ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর শহীদ মইনুল রোডের বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের করে দেয়া হয় খালেদা জিয়াকে। বল প্রয়োগ করে বাড়ির ফটক ও শয়ন কক্ষের দরজা ভেঙে ফেলে নিরাপত্তাবাহিনী। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সেনানিবাস থেকে বের করে দেয়াই ছিলো হাসিনার মূল উদ্দেশ্য। ২০০৯ সালে ফেব্রুয়ারিতে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে অভিষেক শুরু হয় হাসিনার। সে সময়ই সেনা হত্যার ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে এপ্রিলে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয়া হয় খালেদা জিয়াকে। বিষয়টি গড়ায় আদালতে। সকল আইন ও নিয়মনীতি অমান্য করে শেষ পর্যন্ত বাড়ি ছাড়া করেন । এই ঘটনার মধ্য দিয়ে নৈরাশ্যবাদী হাসিনা চরিতার্থ করেন দীর্ঘ দিনের লালিত প্রতিহিংসা। খালেদামুক্ত করেন সেনানিবাস। কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! এক যুগের ব্যবধানে খালেদা জিয়া ঠিকই সসম্মানে ফিরেছেন সেনানিবাসে। সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন তিনি। অপরদিকে গণঅভ্যুত্থানের মুখে শুধু গণভবন নয়, দেশছাড়া হয়েছেন হাসিনা।

অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্র্রীয় অনুষ্ঠানটিতে খালেদা জিয়ার আতিথ্য গ্রহণের বিষয়টি পরিণত হয়েছে “টক অব দ্য কান্ট্রিতে।” রাষ্ট্র বিরল সম্মান প্রদর্শন করেছে বয়োবৃদ্ধ আপোষহীন এই নেত্রীকে। ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে জেল-জুলুম ও চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন খালেদা জিয়া। শারীরিকভাবে গুরুতর অসুস্থ খালেদা জিয়াকে সেনাকুঞ্জে স্বাগত জানান তিন বাহিনীর প্রধান। খালেদা জিয়ার প্রতি অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অভাবনীয় বিনয় ও সম্মান প্রদর্শন গর্বিত করেছে গোটা জাতিকে। প্রশংসিত হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের আচরণও। যা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য বহন করছে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। অনুষ্ঠানে প্রথম সারিতে পাশাপাশি আসন ছিলো ড. ইউনূস ও খালেদা জিয়ার। তারা পারস্পরিক কুশল বিনিময় করেন একজন ডাইনে ঝুঁকে, অপরজন বাঁয়ে বেঁকে। দুজনের সৌজন্যভরা অন্তরঙ্গ এই দৃশ্যটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দৃশ্যটি রাজনীতিকদের জন্য শিক্ষনীয় হবে এমনটিই প্রত্যাশা দেশবাসীর।

উচ্ছেদের সূচনা যেভাবে-

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয় বিডিআর সদর দফতর পিলখানায়। সুপরিকল্পিতভাবে দেশের সুশৃংখল সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ৫৭ জন মেধাবী সেনা অফিসারদেরকে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের আসল ঘটনা চাপা দিতে সরকার ইস্যু করে অনেকগুলো নন-ইস্যুকে। তারই অংশ হিসেবে সেনানিবাসের বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে। মাত্র ১৫দিনের মধ্যে দীর্ঘ ৩৭ বছরের বসতবাড়ি ছেড়ে দিতে বেঁধে দেয়া হয় সময় সীমা। সর্বশেষ জিয়া পরিবারের সেনানিবাসস্থ শহীদ মইনুল রোডের বাড়ির ইজারা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। অত্যন্ত কৌশলে তারা কটাক্ষ করতে থাকেন মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে। উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে তার স্মৃতি চিহ্ন মুছে ফেলার। অশালীন উক্তি করেন বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কেও। শহীদ জিয়ার স্মৃতি বিজড়িত সেনানিবাসের বাড়ি থেকে তার পরিবারকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত ছিল হিংসাত্নক। ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান নিযুক্ত হওয়ার পর থেকেই শহীদ মইনুল রোডের বাড়িতে সপরিবারে উঠেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এ বাড়ি থেকেই সিপাহী-জনতা তাকে মুক্ত করে অংশীদার করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার। এরপর সেনাপ্রধান, সরকার প্রধান, এমনকি রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পরও আমৃত্যু এই বাড়িতে ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জননন্দিত প্রেসিডেন্ট জিয়া। বাড়িটির প্রতিটি ইট, বালি-কণা শহীদ জিয়ার স্মৃতিধন্য। ১৯৮১ সালের ৩০ মে কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে শাহাদাত বরণ করেন জিয়া। তার মরদেহ সেনানিবাসের বাড়িতেই নিয়ে যাওয়া হয় প্রথমে। প্রশ্নাতীত দেশপ্রেম, সততা, নির্মোহতা ও নিষ্ঠার কারণে জিয়ার জনপ্রিয়তা ছিলো আকাশচুম্বী। অতিশয় সাদামাটা জীবন যাপনকারী জিয়ার শাহাদাত বরণের পর তার নিঃস্ব পরিবারের ছিলো না মাথা গোঁজার ঠাই। সেসময় দেশের মানুষের আবেগ-অনুভূতি ও জিয়ার প্রতি ভালোবাসার কারণেই তৎকালীন সরকার ১৯৮২ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে জিয়া পরিবারকে বরাদ্দ দেয় সেনানিবাসের বাড়িটি। শহীদ জিয়ার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্র স্বপ্রণোদিত হয়েই তার অসহায় পরিবারকে বাড়িটি বরাদ্দ দেয়। খালেদা জিয়া কারো নিকট আবেদন-নিবেদন করে নেননি বাড়িটি। শহীদ জিয়ার স্মৃতিকে আকড়ে ধরে বেগম খালেদা জিয়া তার দু’সন্তানকে নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন এই বাড়িতে। তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পরও এই বাড়ি ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী ভবনে উঠেননি তিনি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে এ বাড়িতেই অন্তরীণ রাখা হয় তাকে। এক-এগারো পরবর্তী সময়ে এ বাড়ি থেকেই গ্রেপ্তার করা হয় তাকে এবং তার দু’পুত্রকে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর হাসিনার শ্যান দৃষ্টি পড়ে বাড়িটির উপর। তখন থেকেই বাড়িটি ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা চালায় আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু তাতে সফল না হওয়ায় ২০০১ সালের ২ জুলাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধানমন্ডিতে শেখ রেহানার নামে একটি বাড়ি বরাদ্দ দেয়। দখলী স্বত্ব নিয়ে জটিলতা থাকায় পরবর্তীতে বাড়িটির বরাদ্দ বাতিল করে দেয় বিএনপি সরকার। শেখ হাসিনা নিজে ১ টাকা মূল্যে রাষ্ট্রীয় আইকন গণভবন খরিদ করে নেয়ার উদ্যোগ নিলে তা ভন্ডুল হয়ে যায় গণপ্রতিবাদের মুখে। গণভবন হারানোর দুঃখবোধ থেকেই শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেন চেষ্টা করেন অন্তজ্বালা নিবারণের জন্য। শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেন, খালেদা জিয়া বাড়িটি ছেড়ে দিলে বিডিআর হত্যাকাণ্ডে শহীদ পরিবারদেরকে সেখানে ফ্ল্যাট তৈরি করে দেয়া হবে। একটি শহীদ পরিবারকে উৎখাত করে অন্য শহীদ পরিবারকে সেখানে পুর্ণবাসন করার চিন্তা শুধু অযৌক্তিকই নয়, অনৈতিকও বটে। সরকার একবার বলেন খালেদা জিয়ার বাড়ি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে অবৈধভাবে । আবার বলেন তার নামে বরাদ্দকৃত বাড়িটির শর্ত বরখেলাপ করেছেন তিনি। এক একবার একেক ধরনের কথা বলেন।

খালেদা জিয়ার এই বাড়ি ছাড়া সেনানিবাস এবং ৫৬ হাজার বর্গমাইল আয়তনের বাংলাদেশে আর কোথাও কি কোনো জায়গা ছিল না পিলখানা শহীদদের ফ্ল্যাট তৈরির জন্য? খালেদা জিয়ার বাড়িটিই কেন বেছে নেয়া হলো? সেনানিবাসে থেকে রাজনীতি করা যাবে না এমন কোনো আইন বাংলাদেশের সংবিধানে নেই। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী লেঃ কর্নেল (অবঃ) ফারুক খান সহ বহু নেতা রাজনীতি করছিলেন সেনানিবাস এলাকায় বসবাস করে। খালেদা জিয়ার নামে সেনানিবাসে যে বাড়িটি বরাদ্দ দেয়া হয় তাতে নাকি অনুমোদন ছিলো না মন্ত্রীসভার। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই বছর ১ এপ্রিল লিখিত প্রশ্নোত্তরে জাতীয় সংসদকে জানিয়েছিলেন ১৯৮২ সালের ১৯ মার্চ এবং ২৫ মে অনুষ্ঠিত তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী ও দু’পুত্রের জন্য শহীদ মইনুল রোডের বাড়ি ২.৭২ একর জমি সহ ১টাকা প্রিমিয়ামের বিনিময়ে বার্ষিক ১টাকা হারে খাজনা প্রদানের শর্তে বরাদ্দ দেয়া হয়। এ ধরনের অসঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্যের মধ্য দিয়েই বোঝা যায় হাসিনার হীন উদ্দেশ্য কি ছিলো।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা এতোটাই প্রতিহিংসাপরায়ণ যে, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, এমনকি মৃত্যু নিয়েও বাহাস করতে কসুর করেননি। বিলম্বে হলেও খালেদা জিয়াকে সম্মানিত করেছে রাষ্ট্র। পক্ষান্তরে ৪৫ মিনিটের আল্টিমেটামে গণভবন ত্যাগ করে দেশছাড়া হন হাসিনা। এক-এগারোর ঘটনায় দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন হাসিনা। খালেদা জিয়া কারো ভয়ে দেশ ত্যাগ করেননি কখানো। মহান আল্লাহ তা’য়ালা “ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না।” এটাই সত্য, এটাই ইতিহাস।


সম্পর্কিত খবর