বুধবার , ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

জাতীয়

জুমার বয়ান কেমন হওয়া উচিত, শোনার গুরুত্ব ও ফজিলত

জুমার দিন ও জুমার নামাজ তাৎপর্যময়। দিনটি মুসলমানদের সাপ্তাহিক সম্মিলনের দিন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পাঞ্জেগানা মসজিদ, বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত কিংবা দোকান-পাটে পড়া গেলেও জুমার নামাজ জুমা মসজিদ ছাড়া আদায় করা যায় না। তাই এদিন মুসলিমবিশ্বের মসজিদে মসজিদে ধনী-গরিব, ছোট-বড় সবশ্রেণির মুসলমানের সমাবেশ ঘটে।

জুমার নামাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো খুতবা। আরব দেশগুলোতে শুধু আরবি ভাষায় খুতবা দেওয়া হয়। আরবিতে খুতবা পড়া ও শোনা ওয়াজিব বা অবশ্য পালনীয়। তাই এটা কখনো পরিত্যাগ করা যাবে না। আমাদের বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলোতে আরবি মূল খুতবার আগে মুসল্লিদের বোঝার জন্য নিজ নিজ মাতৃভাষায় বয়ান করা হয়। সাধারণত আরবি খুতবার বিষয়বস্তুর আলোকেই ভাষান্তর বা ভাবান্তর করা হয়। আর খুতবাও হয়ে থাকে সমসাময়িক বিষয় নিয়েই।

জুমার নামাজের আগে বয়ান করা সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর যুগেও ছিল। এতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এ বয়ান খতিব সাহেব বা অন্য কেউ করতে পারেন। আসেম (রহ.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, জুমার দিন হজরত আবু হুরায়রা (রা.) জুতা খুলে মিম্বরের পাশে দাঁড়িয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিভিন্ন বাণী পেশ করতেন। (মুসতাদরাকে হাকিম : ১/১৯০)।

বয়ান তথা দাওয়াতের গুরুত্ব তুলে ধরে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা মানুষকে কল্যাণের পথে আহ্বান করবে, সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় কাজে বাধা দান করবে। তারাই হলো সফলকাম।’ (সূরা আলে ইমরান : আয়াত-১০৪)

বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা একটি আয়াত হলেও আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও।’ (তিরমিজি)

জুমার এই বয়ান হতে পারে অপরাধ ও কুসংস্কার মুক্ত ইসলামি আদর্শ সমাজ গড়ার মাধ্যম। সেজন্য প্রয়োজন সম্মানিত খতিব, মুসল্লি বিশেষত মহল্লাবাসী ও মসজিদ কমিটির ঐকান্তিক ইচ্ছা, চেষ্টা ও পারস্পরিক সহযোগিতা। কমিটির লোকজন একজন হকপন্থী যোগ্য আলেমকে খতিব নিয়োগ দেবেন, যিনি কুরআন-হাদিসের আলোকে ইসলাম, সমাজ ও মানুষের অসঙ্গতিগুলো পর্যায়ক্রমে প্রতি জুমায় তুলে ধরবেন। যেমন সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, যৌতুক প্রথা, ইভটিজিং, নারী নির্যাতন, কুসংস্কার, মাদকাসক্তি, যুব সমাজের অধঃপতন, ইসলাম ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমকালীন প্রসঙ্গ ইত্যাদি।

মক্কা মোকাররমার মসজিদে হারাম এবং মদিনা মোনাওয়ারার মসজিদে নববীর জুমার খুতবায়ও সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এছাড়া কুরআন-হাদিসের আলোকে দুনিয়ার জীবন, পরকালের জীবন, জান্নাতের শান্তি, জাহান্নামের শাস্তি ইত্যাদি বিষয়ে তো আলোচনা করবেনই। মোটকথা, খতিব সাহেব প্রচলিত নিয়মে আলোচনার নির্দিষ্ট বিষয়ে না থেকে ইসলামের সার্বিক বিষয় পর্যায়ক্রমে মুসল্লিদের মাঝে তুলে ধরবেন। এক্ষেত্রে মুসল্লিরাও আগে-ভাগে মসজিদে গিয়ে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এভাবে প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা শুনতে শুনতে মুসল্লিদের ইসলাম সম্পর্কে জানার পরিধি বাড়বে। ইসলাম ও সমাজের অসঙ্গতিগুলো দূর হতে থাকবে।

জুমার আজানের পর জুমার নামাজ ছাড়া অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আর জুমার দিন জুমার নামাজে আগে-ভাগে হাজির হওয়া এবং মনোযোগ সহকারে জুমার বয়ান ও খুতবা শোনার বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলতের কথা বলা হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ইউসুফ (রা.) ও আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন ফরজ গোসলের মতো গোসল করে নামাজের জন্য আসে, সে যেন একটি উট কুরবানি করল। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় পর্যায়ে এলো, সে যেন একটি গাভী কুরবানি করল। যে ব্যক্তি তৃতীয় পর্যায়ে এলো, সে যেন একটি শিং বিশিষ্ট দুম্বা কুরবানি করল। যে ব্যক্তি চতুর্থ পর্যায়ে এলো, সে যেন একটি মুরগি কুরবানি করল। যে ব্যক্তি পঞ্চম পর্যায়ে এলো, সে যেন একটি ডিম কুরবানি করল। পরে ইমাম যখন খুতবা প্রদানের জন্য বের হয়, তখন ফেরেশতারা জিকির শোনার জন্য হাজির হয়ে থাকেন। (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি)

কিন্তু অনেক মসজিদে মুসল্লিরা সময়ক্ষেপণ করে মসজিদে আসে। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খতিব সাহেব যথাসময়ে বয়ান শুরু করতে পারেন না, কিংবা মোটেও বয়ান করা হয়ে ওঠে না। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, দেশের অধিকাংশ মসজিদেই খতিব সাহেব স্বাধীনভাবে কুরআন-হাদিসের কথা বলতে পারেন না। সেজন্য তাদের ওপর বাধা ও চাপ আসে। সব মতাদর্শের ওপর ইসলামি মতাদর্শকে প্রাধান্য দিয়ে স্বাধীন আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করা এলাকাবাসীর ঈমানি দায়িত্ব।

আবার কোনো কোনো মসজিদে বিশেষ করে মফস্বলের মসজিদে বলতে গেলে বয়ানই হয় না। হয়তো খতিব সাহেব সেভাবে কথা বলতে অভ্যস্ত নন অথবা খতিব-মুসল্লি কেউই এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেন না। মুসল্লিরা অযথা বসে থেকে গল্প-গুজব করে সময় নষ্ট করেন। আর এভাবেই বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে। এমন করা মোটেও উচিত হচ্ছে না। অথচ দেখা গেছে, এই মসজিদগুলোতেই মাহফিলের নামে প্রতি বছর লাখ টাকা খরচ করা হয়। একেক জন বক্তাকে ৪০/৫০ হাজার টাকা করে হাদিয়া দিয়ে এনে ওয়াজ করাতে পারলে, ভালো সম্মানী দিয়ে একজন ইমাম-খতিব কেন নিয়োগ দেওয়া যাবে না? মাহফিলে তো শুধু একদিন ওয়াজ শোনা যায়, আর খতিব সাহেবের মাধ্যমে শোনা যাবে প্রতি সপ্তাহে। বাস্তবতা হলো, মাহফিল থেকে জুমার নামাজপূর্ব বয়ান অনেক ফলপ্রসূ। কারণ মাহফিলে সাধারণত একশ্রেণির ধার্মিক মুসলমানÑ যারা ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি অবগত তারা যান। আর জুমার নামাজ আদায় করতে সমাজের উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, বৃদ্ধ, যুবক, শিশু-কিশোর সর্বস্তরের মুসলমান হাজির হন। এজন্য তাদের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছানো আরও বেশি জরুরি এবং সহজ।

আলহামদুলিল্লাহ, দেশের কিছু মসজিদে বিশেষ করে রাজধানী, জেলা ও থানা শহরের বিভিন্ন মসজিদে একদল যোগ্য তরুণ আলেম-খতিব বয়ানের এই উপকারী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বিভিন্ন প্রতিকূলতা এড়িয়ে এই ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করছেন। সমাজের সাধারণ মানুষ এর মাধ্যমে অনেক উপকৃত হচ্ছেন। মুসল্লিদেরও তারা সেভাবে গড়ে তুলেছেন।

আমরাও যদি সমাজ বদলের এই মিছিলে শামিল হতে চাই, তাহলে মুসল্লিদের সঙ্গে পরামর্শ করে বয়ানের সময় ঠিক করে নেওয়া যায়। সহজ পদ্ধতি হলো, প্রথম আজানের পর বয়ান শুরু করবেন, মুসল্লিরা এসে নীরবতার সঙ্গে বয়ান শুনবেন। খুতবার পাঁচ-দশ মিনিট আগে তা শেষ করে মুসল্লিদের সুন্নত পড়ার সুযোগ দেবেন। এরপর খতিব সাহেব আজানের পর আরবি ভাষায় দুটি খুতবা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নামাজ পড়াবেন। (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১২/৩৮৬-৩৯২)

ইসলামের আলোকে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে দেশের প্রতিটি জুমা মসজিদে ইলম ও আমলদার সহি আকিদার যোগ্য আলোচক খতিব নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন এবং খতিবদেরও সমাজের চাহিদা অনুযায়ী যুগোপযোগী বয়ান করা কর্তব্য।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম


সম্পর্কিত খবর