ডেস্ক নিউজ:
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বলয়ের বাইরে থাকা ইসলামপন্থি দলগুলোকে একমঞ্চে নিয়ে আসতে চাইছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলনের নজরও এই দলগুলোর দিকে। জানা গেছে, এই দুই দলই ইসলামপন্থি বলে পরিচিত ছোট দলগুলোকে নিয়ে জোট করে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে লড়াই করার চিন্তা করছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, জোট গড়ার লক্ষ্য নিয়ে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন পৃথকভাবে ওই দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক ও যোগাযোগ শুরু করেছে। ইসলামী আন্দোলনের আমির চরমোনাই পীরের নেতৃত্বে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ৬টি দলকে একত্রিত করে জোট বা সমঝোতা করার চেষ্টা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। নীতিগতভাবে ঐকমত্য পোষণ করছে কওমি দলগুলো। এরপর তারা জামায়াতসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করবে।
অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের আপাতত কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে বনিবনা নাও হতে পারে এমনটি ধরে নিয়েই ইসলামপন্থিদের নিয়ে জোট গড়তে তৎপরতা চালাচ্ছে জামায়াত। তাই একই মতাদর্শের দল ও আলেমদের সঙ্গে বৈঠক করছে দলটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, সম্ভাব্য জোটের একটি রূপরেখা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে দলটি। যদিও তা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো রূপ নেয়নি। এরপর ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বৈঠক হবে। জানা গেছে, আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক এখন পর্যন্ত না হলেও জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খবরের কাগজকে বলেন, ‘সব দলের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে মতবিনিময় ও বৈঠক হয়েছে। তবে কোনো কিছুই এখনো চূড়ান্ত হয়নি। জোটের রীপরেখা কী হবে, কোন পদ্ধতিতে জোট হবে এসব বিষয়ে নিয়ে আলোচনা চলছে।’ তিনি বলেন, জোট গঠনের ব্যাপারে সবাই আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তারা বলছেন ইসলামি দলগুলোকে এক থাকতে হবে; যেন ফ্যাসিবাদের উত্থান না হয়।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কারণে প্রায় ১৫ বছর পর প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরেছে জামায়াতে ইসলামী। এই মুহূর্তে সারা দেশে দলটি সাংগঠনিক কার্যক্রমে ব্যস্ত। দেশজুড়ে প্রতিদিনই অঙ্গসংগঠনগুলোর কোনো না কোনো কার্যক্রম চলছে। নির্বাচনি এলাকায় দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও প্রচার ও গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে দীর্ঘদিনের ‘ফেরারি’ অবস্থান থেকে হঠাৎ করে রাজনীতির সম্মুখভাগে আসা জামায়াতের জোট গঠন নিয়ে অনেকের মধ্যে নানা আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্রমতে, নির্বাচনি ঐক্য গড়ার লক্ষ্য নিয়ে জামায়াত গত ১৫ আগস্ট থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন, ১২–দলীয় জোট, জাকের পার্টি, লেবার পার্টি, খেলাফত মজলিস, গণ অধিকার পরিষদ (নুর), ববি হাজ্জাজের এনডিএম ও ফরায়েজী আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদীসহ ব্যক্তিপর্যায়ে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক ও আলেমদের সঙ্গে জামায়াতের আমির পৃথক পৃথকভাবে মতবিনিময় করেছেন।
কার্যত ‘আকিদা’ ও ‘হক’ নিয়ে কওমি ধারার আলেমদের সঙ্গে জামায়াতের দীর্ঘদিনের বিরোধ বা বিতর্ক ছিল। তবে বর্তমানে সেটি কমেছে। তবে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে জোট হবে কি না, তা নির্ভর করছে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের ওপর।
চরমোনাই পীরের নেতৃত্বে কওমি মাদ্রসাভিত্তিক ৬ ইসলামি দল একত্রিত হচ্ছে। দলগুলো হচ্ছে খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত আন্দোলন। ইতোমধ্যে কয়েকটি দলের সঙ্গে ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ বৈঠক করেছে ইসলামী আন্দোলন। ‘নির্বাচনি ঐক্য বা সমঝোতা’র আলোচনাও বহু দূর এগিয়েছে। জোট করতে সবাই নীতিগতভাবে একমত। জোটের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রতিটি দলের শীর্ষ নেতাদের সমন্বয়ে লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করার চিন্তা করা হচ্ছে। কওমি দলগুলো এক হওয়ার পরই জামায়াতের সঙ্গে জোট বা সমঝোতার ব্যাপারে আলোচনা হবে। এর বাইরে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে ইসলামী আন্দোলনের।
ইসলামী আন্দোলনের একাধিক নেতা বলেন, প্রথমে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলো এক হবে। এরপর এই জোট সিদ্ধান্ত নেবে ভবিষ্যতে জামায়াতের সঙ্গে জোট হবে কি না? তবে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনি জোট বা সমঝোতা হবে, এটা ঠিক।
ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে থাকা দলগুলোকে একত্রিত করতে চাইছি। সবার সঙ্গেই সম্পর্ক ও যোগাযোগ হচ্ছে। কীভাবে কাছাকাছি আসা যায় সেই চেষ্টা চলছে। আমাদের প্রথম লক্ষ্য ইসলামি দলগুলোকে এক করা। আগে কাছাকাছি থাকা দলগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া হবে। এরপর জামায়াতসহ অন্যদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে। নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে তার ওপরই নির্ভর করবে জোটের বিষয়। নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার পরই হয়তো জোটের কাঠামো রূপ লাভ করতে পারে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব জালালুদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলো কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে। সব দলই নির্বাচনি জোট গঠন করতে ইচ্ছুক। জোটগতভাবে ভোটের মাঠে অংশ নিতে চাইছে।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ‘নির্বাচনকালীন ঐক্য গড়ার চেষ্টা আমাদের আছে। নীতিগতভাবে একটি আসনে ইসলামি দলের পক্ষ থেকে একজন প্রার্থী দাঁড় করানোর ব্যাপারে আমরা একমত। ওলামা নেতৃত্বে থাকা দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হওয়ার পর জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা হবে।’ জামায়াতের সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে তিনি বলেন, এই প্রশ্নে জামায়াতও একই মত প্রকাশ করেছে। অনেক ইস্যু সামনে চলে আসায় আর আলোচনা এগোয়নি। নির্বাচনি রোডম্যাপ দেওয়ার পরই হয়তো মূল আলোচনা হবে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে এখনো কোনো দলের সঙ্গে বসাবসি হয়নি। আনুষ্ঠানিক কোনো কথাবার্তা এখনো না হলেও শিগগিরই হয়তো বসা হবে। জামায়াতের ব্যাপারে আকিদা প্রশ্নে আমাদের আপত্তি রয়েছে। তাই ভেবে-চিন্তে সবাইকে এগোতে হবে।’
বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, জামায়াতে ইসলামী বড় দল। তাদের সঙ্গে কিছু মতপার্থক্য থাকলেও আশা করছি সবাইকে নিয়েই ঐক্য হবে। ইসলামি দলগুলোর ঐক্য এখন সময়ের দাবি।
গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ৬-দলীয় ‘সমমনা ইসলামী জোট’ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ভোটে অংশ নিয়েছিল খেলাফত আন্দোলন। দলটির মহাসচিব মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী খবরের কাগজকে বলেন, ‘জোট তো ভালো জিনিস। জোটে তো যাওয়াই দরকার। কওমিভিত্তিক দলগুলোর সুন্দর জোট হলে আমরা আছি এবং থাকব ইনশাআল্লাহ। তবে এখন পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ বা বৈঠক হয়নি। আগে নিজেদের মধ্যে জোট গঠনের পর সব দলের প্রধানরা মিলে জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা করবেন। আশা করি, তাদের সঙ্গেও জোট হবে।’
উল্লেখ্য, গত ৪ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার ২৩ দিনের মাথায় দল নিষিদ্ধের আদেশও প্রত্যাহার হয়। এখন নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার জন্য আপিল করেছে জামায়াত।